সতর্ক চোখে একবার দেখুন নিজের চারপাশে, আপনার কোন আপনজন নেইতো এমন পিলে চমকানো পরিসংখ্যানে !
তথ্যটা পিলে চমকে দেবার মতই! ইয়াবা, ফেন্সিডিল ইত্যাদি নেশা বাদে শুধুমাত্র মদে আসক্ত নারীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। হ্যা, পরিসংখ্যানটা বাংলাদেশেরই !
সংশ্লিষ্ট সুত্রের দেয়া পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০১৪ সালে দেশে নারী মদপানকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ১০ হাজার। ২০১৫ সালে ৪ লাখ ৯০ হাজারে বেড়ে দাঁড়ায় এই সংখ্যা । গত ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা ঠেকে ৫ লাখ ৬০ হাজারে। কিন্তু সবচেয়ে চমকে দেবার মত ব্যপার হলো, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরের এ পর্যন্ত দেশে নারী মদপানকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখে। এরমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে নারী মদপানকারীর সংখ্যা সোয়া ৩ লাখ এবং শুধু ঢাকায় ১ লাখ নারী মদপান করেন অনেকটাই নিয়মিত।
তবে সংশ্লিষ্টরা সহ অনেকেই বলছেন, শুধুমাত্র হিসেব-নিকেশের খাতায় সংখ্যাটা এমন হলে মুলত নারী মাদকসেবীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের সুত্রে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ,বাংলাদেশে দেশে মদপানকারীর সংখ্যা ৬০ লাখ। এরমধ্যে ১০ শতাংশই হচ্ছেন নারী। সে হিসেবে ৬ লাখ নারী নিয়মিত মদ পান করেন। আর নারীদের মধ্যে মদসেবনকারীদের বেশির ভাগই হচ্ছেন তরুণী অথবা যুবতী ।এর আগে ‘ মাদকের বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না’ বলে স্বীকার করেছিলো খোদ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গত ১৯ ডিসেম্বর মাদ্রকদ্রব্র নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ। এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি জানিয়েছিলেন , বিশেষ করে ইয়াবার সেবন বেড়েছে ৩০ শতাংশ। আর নারী মাদকসেবীর সংখ্যাও ক্রমে বাড়ছে। সেসময়, নারী ও শিশু মাদকসেবীর সংখ্যা কত-এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কাছে রেশিওটি নেই, তবে বলতে পারি, আগের তুলনায় নারী মাদকসেবীদের সংখ্যা বাড়ছে।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দেশের সব ইউনিয়ন, মাদক নিরাময় কেন্দ্র এবং সরকারি নিবন্ধনকৃত বার ও পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে জরিপ চালিয়ে এ পরিসংখ্যান তৈরি করেছে।পুরুষদের বিষয়টি সামনে এলেও নারীরা পর্দার অন্তরালে থেকে নিজেদের বিলীন করে দিচ্ছে। মাদক ধ্বংস করে দিচ্ছে ফুলের মতো কতগুলো মানুষের জীবন। তারা এ বিষয়টি শখের বসে নিতে গিয়ে পরে মাদকাসক্ততে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আগে দেখা যেত পুরুষদের মাদক সেবনের প্রতি ঝোঁক বেশি। কিন্তু বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বিপজ্জনক হারে এ জগতে প্রবেশ করছে। দিন দিন এর পরিমাণ বেড়েই চলছে।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি বিশ্বস্ত সুত্র জানিয়েছেন,মদপানের ক্ষতির বিষয়ে সারা দেশের নারীদের সচেতন করার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে তারা দেখেছেন, আশংকাজনকহারেই দিন দিন অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ছেন নারীরা। এরমধ্যে তরুণীর সংখ্যা বেশি। তবে এ সংখ্যা গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি। পরিসংখ্যানে বরাত দিয়ে ঐ সুত্রটি জানায় , এমনকি কিছু নারী গর্ভাবস্থায়ও মদপান করে আসছেন ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, যেসব নারীর মদে আসক্তি রয়েছে এর বেশির ভাগ উচ্চবিত্ত পরিবারের। ৬ লাখ নারী মদপানকারীর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ হচ্ছে বিভিন্ন পেশাজিবী ও বয়সের । তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, বাকি ৪০ শতাংশ নারী হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন কলেজ ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী।
সূত্রটির বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে প্রকাশ করা হয়েছে, এই সংখ্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী অনুমতি (মদের লাইসেন্স) নিয়ে নিবন্ধনকৃত খোলা বারগুলোতে (কিছুক্ষেত্রে নিজে ) গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাধ্যমে সংগ্রহ করে নিজ স্থানে এনে মদপান করেন। সুত্রটি জানায়, সরকারের অনুমতি থাকার কারণে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালায় না।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন চার তারকা ও অভিজাত হোটেলগুলোয় এসব নারীরা মুলত মদপান করেন। এছাড়া রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের নাইটক্লাবগুলোয় পুরুষদের সাথেই দেদারসে চলে নারীদের মদ্যপান । অন্যদিকে ঢাকার বাইরে বন্দর নগীর চট্টগ্রাম ও সাগরকন্যাখ্যাত কক্সবাজারের হোটেলগুলোর বারে জমে নারীদের মদপানের আসর বলেও জানায় সুত্রটি ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জরিপ সুত্রের দেয়া তথ্যে ফুটে উঠেছে ভয়াবহ সব চিত্র!
জরিপ সুত্র বলছে, যেসব নারী ইয়াবা ও সিসায় আসক্ত, তারা মদপানে ঝুঁকে পড়েন। অনেক নারী ইয়াবা ও সিসা সেবন করে মদপান করেন। এছাড়া বেশ কিছু নারীর নেশায় কোনো রকম আসক্তি না থাকা সত্ত্বেও বন্ধু ও বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বা অন্য বন্ধুর অনুরোধে প্রাথমিক অবস্থায় অনেকটাই কৌতুহলের বশেই মদপান করেন।এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুধীর রঞ্জন দেব বলেন, মদপান করার কারণে নারীদের হৃদরোগের সমস্যা বেড়ে যায়। হার্টে তাদের বেশি পরিমাণের রক্ত জমাট বাঁধে। এতে হার্ট অ্যাটাক হয়ে অনেক নারী অকালে মারা যান। তিনি বলেন, মদপানে কর্মশক্তি হারিয়ে যায়, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দশম জাতীয় সংসদের ত্রয়োদশ অধিবেশনে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন জানিয়েছিলেন, ‘ বাংলাদেশে নারী মাদকাসক্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে’
সেসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা নির্ণয়ের বিষয়ে এ পর্যন্ত কোনো জরিপকার্য সম্পন্ন হয়নি। এ বিষয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র সমূহে চিকিৎসার জন্য আগত রোগীদেও মধ্যে নারী মাদকাসক্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্তের জন্য ১৮২টি চিকিৎসা ও পূণবার্সন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী।
বিশেষজ্ঞদের চোখে ভয়াবহ পরিণতি ও কারন
মাদক
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন , নারীরা কৌতুহলের বশে প্রথমে মাদক গ্রহণ করা থেকে
তারা আসক্ত হয়ে পরে। এছাড়া পারিবারিক অশান্তি, যে কোন ধরনের হতাশা,
বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, প্রেমঘটিত ব্যাপার, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, মাদকাসক্ত
বন্ধুদের সঙ্গ এসব কারণেই আজ নারীরা এই মরণ নেশায় আসক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে
স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েরাই বেশি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
জাতীয়
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক টি ইসলাম জানান, ইয়াবা সেবনের পর
প্রথমে মনে হয় শরীরে অনেক শক্তি এসেছে, যৌনশক্তি বেড়ে গেছে, সব ক্লান্তি
কেটে গেছে। এটি একটি উত্তেজক মাদক। দীর্ঘমেয়াদে এটি পুরো স্নায়ুতন্ত্রের
ওপর প্রচন্ড খারাপ প্রভাব ফেলে। স্নায়ুুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাঠামো ও
কার্যক্রম নষ্ট করে দেয়। এ ধরনের মাদকের প্রভাবে অনেক সময় মানুষ বদ্ধ
পাগলের মতো আচরণ করে (সাইকোসিস সিনড্রম)। সেবনের পরপর অনেক ফুরফুরে লাগলেও
এর প্রভাব কমে যাওয়ার পরই শরীরময় নেমে আসে রাজ্যের অবসাদ ও ক্লান্তি। ফলে
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের (স্ট্রোক) ঝুঁকিও তৈরি হয়।
বিশেষজ্ঞরা
জানাচ্ছেন, পুরুষরা মাদকাসক্ত হলে তাদের নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে চিকিৎসা
করানো হয়। ফিরিয়ে আনা হয় স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু নারী মাদকসেবীরা চিকিৎসার
সীমাবদ্ধতা, সামাজিক মূল্যবোধসহ নানা কারণে পর্দার অন্তরালে থেকে যায়।
অনেকে সুস্থ হয়ে উঠতে চাইলেও সমাজে জানাজানি হয়ে যাবে এতে বিয়েশাদিতে
পারবর্তীকালে সমস্যা হতে পারে। ক্ষুন্ন হতে পারে সামাজিক মর্যাদা এসব কারণে
নারীরা লোকলজ্জায় চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে অনীহা জানায়। চিকিৎসা না নেয়ার
প্রবণতায় দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। পাশাপাশি
নেশার জগত থেকেও ফিরতে পারছেন না। এর প্রভাব পড়ছে পুরো পরিবারে। পরিবারের
সদস্যদের সঙ্গে প্রতিনিয়তই মিথ্যা কথা বলে তরুণীরা নেশার জগতে বুদ হয়ে
থাকে। তারা যে নেশা করে সেই সত্যতা গোপন করার জন্য প্রতিনিয়তই মিথ্যার
আশ্রয় নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য
নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) এম এ হোসেন
বলেন, মাদকাসক্ত নারীকে সমাজ ভিন্ন চোখে দেখে। এই মানসিকতা ও লোকলজ্জায়
নারী মাদকাসক্তরা চিকিৎসা সেবা নেন না বললেই চলে। মাদকাসক্ত নারীরা পুরুষের
তুলনায় দ্রুত আক্রান্ত হয়। তাদের চিকিৎসা না দিলে ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব
পড়ে। নারী মাদকাসক্তদের প্রথম পছন্দ ইয়াবা। এরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে
সহিংস আচরণ দেখায়। আর এসব বিষয় গোপন রাখায় নারীরা দীর্ঘমেয়াদী
স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পারিবারিক সচেতনতা জোরদার
করা জরুরী বলে মনে করেন তিনি।
No comments:
Post a Comment